আবু সাইদ :পবিত্র কোরআনে আগের একাধিক জাতির ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। নিছক ঘটনার বর্ণনা এর উদ্দেশ্য নয়; বরং মুসলিম গবেষকরা বলেন, জ্ঞানী ব্যক্তিদের উচিত পূর্ববর্তী জাতিগুলোর অবস্থা, তাদের ব্যাপারে আল্লাহর বিচার ও বিধান, শাস্তি ও পুরস্কার ইত্যাদি সম্পর্কে জানা। যেন তার মাধ্যমে নিজেকে এবং স্বজাতিকে সতর্ক করতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের ঘটনাবলিতে আছে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ১১১)
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদেরকে পূর্ববর্তীদের ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যেন তা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হয়, আমাদের অবস্থাকে তাদের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয় এবং পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নেয়। সুতরাং পরবর্তী মুমিনদের সঙ্গে আগের মুমিনদের সাদৃশ্য এবং পরবর্তী অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের পূর্ববর্তীদের অবিশ্বাসী ও মুনাফিকদের মিল রয়েছে।’ (মাজউল ফাতাওয়া : ২৮/৪২৫)
আগের জাতির জন্য আল্লাহর শাস্তি
আগের জাতিগুলোকে আল্লাহ দুই ধরনের শাস্তি দিয়েছেন। এক. সর্বগ্রাসী শাস্তি। যার মাধ্যমে জাতি ও গোত্রের সবাইকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের কেউ সেই শাস্তি থেকে রক্ষা পায়নি। যেমনটি হয়েছিল নুহ, আদ ও সামুদ জাতির সঙ্গে। ইসলাম গবেষকদের দাবি, আল্লাহ আপন অনুগ্রহ ও দয়ায় মানবজাতি থেকে এমন সর্বগ্রাসী শাস্তি রহিত করেছেন।
দুই. এমন শাস্তি, যা জাতি ও সম্প্রদায়ের জীবন সংকীর্ণ করে তোলে, তবে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয় না। যেমন—মহামারি, ঝড়-তুফান ও ভূমিকম্প।
ধ্বংসের কারণগুলো
আল্লাহ নানাবিদ কারণে পূর্ববর্তী জাতিগুলোকে ধ্বংসের মুখোমুখি করেছেন, যার কয়েকটি হলো—
এক. বিচারব্যবস্থার নৈরাজ্য : প্রতিটি অপরাধ ও সীমা লঙ্ঘনের বিপরীতে আল্লাহ শাস্তির বিধান রেখেছেন। আগের জাতিগুলো আল্লাহর শাস্তির বিধান বাস্তবায়নে বৈষম্য করেছিল। ফলে আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন। উসামা বিন জায়েদ (রা.) একজন কুরাইশি নারীর শাস্তি হ্রাসের ব্যাপারে সুপারিশ করলে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহর হদের ব্যাপারে সুপারিশ করছ?’ অতঃপর তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের আগে যারা ধ্বংস হয়েছিল, তাদের মধ্যে কোনো সম্মানিত ব্যক্তি চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং যখন কোনো দুর্বল ব্যক্তি চুরি করত তার ওপর হদ বাস্তবায়ন করত। আল্লাহর শপথ! যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করত আমি তাঁর হাত কেটে দিতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৭৮৮)
দুই. অর্থের মোহ : তীব্র অর্থমোহ ও লিপ্সা মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে এবং কৃপণতা সৃষ্টির মাধ্যমে সম্পদ দ্বারা যথাযথভাবে উপকৃত হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা জুলুম থেকে বিরত থাকো। কেননা তা কিয়ামতের দিন ভীষণ অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে। তোমরা কৃপণতা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করে দিয়েছিল। কেননা তা তাদেরকে রক্তপাত ও অবৈধ জিনিস বৈধ জ্ঞান করতে উৎসাহিত করেছিল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৭৮)
তিন. অনর্থক প্রশ্ন ও বিতর্ক : আম্বিয়া (আ.)-এর বিরোধিতা ও তাঁদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ পূর্ববর্তী জাতিদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক দীর্ঘ হাদিসে বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের আগের লোকেরা নবীদের সঙ্গে বেশি বেশি প্রশ্ন ও তাঁদের বিরোধিতা করে ধ্বংস হয়েছে। আমি যখন তোমাদের কোনো বিষয়ে আদেশ করি তা যথাসম্ভব পালন করো এবং যখন তোমাদের কোনো বিষয়ে নিষেধ করি তা পরিহার করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭২৮৮)
চার. সংশয়পূর্ণ বিষয়ের পেছনে পড়া : পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলোর মধ্যে কোনো অপূর্ণতা, সংশয় ও বিরোধ নেই। তবে কোরআনের কিছু আয়াত সুস্পষ্ট, যাকে মুহকাম বলা হয় আর কিছু আয়াত সবার জন্য সুস্পষ্ট নয়—এগুলোকে মুতাশাবিহ বলা হয়। কোরআনের মুতাশাবিহ আয়াত নিয়ে বিতর্ক সর্বসাধারণের জন্য অনুমোদিত নয়। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদিন সকালে আমি মহানবী (সা.)-এর কাছে গেলাম। তিনি দুই ব্যক্তিকে কোরআনের একটি আয়াত নিয়ে বিতর্ক করতে শুনলেন। ফলে রাসুলুল্লাহ (সা.) বের হয়ে এলেন, তাঁর মুখমণ্ডলে রাগের ছাপ ছিল। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই তোমাদের আগের লোকেরা তাদের কিতাবের ব্যাপারে মতবিরোধ করে ধ্বংস হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৬৬)
পাঁচ. দ্বিনের ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ি : ইসলাম কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি অনুমোদন করে না। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা দ্বিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকো। কেননা তোমাদের আগের লোকেরা দ্বিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে ধ্বংস হয়ে গেছে।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩০৫৭)
ছয়. দ্বিন পালনে শিথিলতা : জাগতিক জীবনে মোহ ও ব্যস্ততা মানুষকে দ্বিন পালনে শিথিল করে দেয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সুসংবাদ গ্রহণ করো এবং যা তোমাদের খুশি করে তার আকাঙ্ক্ষা রাখো। আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্র্যের ভয় করি না, কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করি যে, তোমাদের ওপর দুনিয়া এরূপ প্রসারিত হয়ে পড়বে যেমন তোমাদের অগ্রবর্তীদের ওপর প্রসারিত হয়েছিল। আর তোমরাও দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে, যেমন তারা আকৃষ্ট হয়েছিল। আর তা তোমাদের বিনাশ করবে, যেমন তাদের বিনাশ করেছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২৫৮)
সাত. পাপ ও বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাওয়া : কোরআনের একাধিক স্থানে পাপ ও পাপাচার ছড়িয়ে পড়াকে জাতিগুলোর ধ্বংসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘কেবল পাপাচারী সম্প্রদায়কেই ধ্বংস করা হবে।’ (সুরা : আহকাফ, আয়াত : ৩৫)
আল্লাহ এসব ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করুন। আমিন।
Leave a Reply