সম্পাদকীয় : প্রবাসী নারী শ্রমিকদের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক সময়কালে অত্যন্ত উদ্বেগজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে। পরিবারের অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব ঘোচাতে বিদেশে পাড়ি জমানো নারীদের একটি বড় অংশ দেশে ফিরছেন লাশ হয়ে।বিগত কয়েক বছরে এ ধরনের মৃত্যুর হার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালে প্রবাস থেকে মৃত অবস্থায় দেশে ফিরেছেন ৩৯০ জন নারী শ্রমিক। আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা, স্ট্রোকসহ নানাবিধ কারণে ২০১৬ সালে মোট ৫৭ জন প্রবাসী নারী কর্মী মারা গেছেন।২০১৭ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০২ জনে। গত বছর মৃতের সংখ্যা ছিল ১১২ জন। অথচ চলতি বছর প্রথম দশ মাসেই মৃত্যুর সংখ্যা আগের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে; এ সময়ে দেশে ফিরেছে ১১৯ জন নারী কর্মীর লাশ।
তথ্য বলছে, ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত পনেরো বছরে মোট ৩ হাজার ৭৯৩ জন নারী শ্রমিক প্রবাসে মারা গেছেন। আর এ মৃত্যুর হার সবচাইতে বেশি সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন, ওমান ও আরব আমিরাত-এই পাঁচ দেশে।বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি লাশ আসছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এ ধরনের তথ্য নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক এবং একইসাথে আশঙ্কাজনকও বটে। দিনকে দিন এ ধরনের মৃত্যুগুলোর পেছনে কারণ কী? তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এসব মৃত্যুর একটি বড় অংশের কারণ আত্মহত্যা।কেবল চলতি বছরেই মৃত ১১৯ জনের ৩৩ জনেরই মৃত্যু ঘটেছে আত্মহত্যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, কাজের জন্য দেশের বাইরে গিয়ে একজন শ্রমিক আত্মহত্যা কেন করবেন? এমন কোনো পরিস্থিতি সেখানে তৈরি হচ্ছে যাতে করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প তাদের হাতে থাকছে না? ইতোমধ্যেই নানা উৎস থেকে জানা যাচ্ছে, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের নারীকর্মীদের নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
বিশেষ করে নিয়োগকর্তাদের যৌনলিপ্সা, নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ ইত্যাদি কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এছাড়া অতিরিক্ত কাজের চাপ ও মানসিক যন্ত্রণার ফলে স্ট্রোকজনিত কারণেও মৃত্যু হচ্ছে অনেকের।তা ছাড়া বিদেশে আমাদের নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নানান প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এর একটি কারণ হলো বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের বেশিরভাগই দক্ষতায় পিছিয়ে। তার ওপর বিদেশি ভাষার দুর্বলতা, কাজে অপারদর্শিতা তো আছেই। আবার প্রবাসে নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশও যথোপযুক্ত নয়। প্রতিদিন এসব মৃত্যুতে কেবল কিছু প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে তা নয়, তাদের পরিবারও কপর্দকহীন নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
মাঝবয়সী একজন কর্মীকে কেন লাশ হয়ে দেশে ফিরতে হচ্ছে, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষত জেন্ডার বেইজ্ড ভায়োলোশন হচ্ছে কি না বা শ্রমিকের ওপর কোনোরূপ নির্যাতনের খড়্গ চেপে বসছে কি না- এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোর নিয়মিত খবরাখবর রাখা উচিত। প্রবাসে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ঠিক রাখা, সেবার মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি এবং শ্রমিক-নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল মৃত্যুর এ মিছিল থামানো সম্ভব। এছাড়াও বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির সাথে সম্পৃক্ত এজেন্সি ও দালালদেরও কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা দরকার।
তারা যেন কোনো অনিয়মে জড়িত হতে না পারে এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রাথমিক বিষয়গুলো যেন গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বাধ্য হয়, সে ব্যাপারে তাদরে চাপের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মোটকথা, অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের অনেক কিছুই করার সুযোগ রয়েছে। যেহেতু জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত অর্থেই এদেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, তাই এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ত্বরিৎগতিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন ক্রমবর্ধমান হারে ঘটতে থাকা এ মৃত্যুর ঘটনাগুলোর লাগাম টেনে ধরা যায়।
Leave a Reply