সম্পাদকীয়
বছর দুয়েক ধরেই বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা চলছে। বড় অংকের আমদানির বিপরীতে রফতানি বাড়ছে না। আবার আমাদের রফতানিতে বৈচিত্র্য নেই। মন্দ ঋণ ও খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা। মূল্যস্ফীতির প্রকোপ প্রশমন করতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ঋণের সুদ আগে ১-২ শতাংশ থাকলেও তা ৮-৯ শতাংশ পর্যন্ত ছুঁয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে আরো কয়েকটি ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। এতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় আরো বাড়তে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। এজন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশী ঋণের রাশ টেনে ধরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের বিদেশী ঋণ ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন (১০ হাজার ৬৪ কোটি) ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে) এ ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। দেশের মোট বিদেশী ঋণের ৭৯ শতাংশই নিয়েছে সরকার। বাকি ২১ শতাংশ ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ বিদেশী ঋণের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের শেষ ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের বিদেশী ঋণ ৪ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এ সময়ে সরকারের বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। সরকারের বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ ৩৩ কোটি ডলার কমেছে। গত ডিসেম্বর শেষে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের স্থিতি ২০ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে আরো জানা গেছে, নানা কারণে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিদেশী ঋণের স্থিতি কিছুটা কম দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ডিসেম্বরে এ ঋণের প্রকৃত পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। এতে বিদেশী ঋণ এতটা বেড়েছে।
বিদেশী অর্থায়নে সরকার বেশকিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি।
বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পাশাপাশি জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশী ঋণ নেয় বাংলাদেশ। এসব ঋণের বড় অংশ আসে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে। সাম্প্রতিক কালে স্বল্পমেয়াদি চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নেয়া বেশির ভাগ বিদেশী ঋণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিদেশী ঋণের বিপরীতে রিটার্ন আসছে স্থানীয় মুদ্রায় বা টাকায়, তাই ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশী ঋণের ব্যয় বাড়বে। প্রকল্পগুলোর জন্য পাইপলাইনে যে বিদেশী ঋণ জমা আছে, তা দ্রুত ব্যবহার করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষেও বিদেশী উৎস থেকে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মোট ঋণ স্থিতি ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার ছিল দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। বাকি ৬ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছিল স্বল্পমেয়াদি। ওই সময় বিদেশী ঋণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এর পর থেকে বিদেশী ঋণ ক্রমাগত বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৫৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৬২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে। বিদেশী ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ২০১৮ সালের পর। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৬৮ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশী ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থবছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ৯৫ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়। এতে বিদেশী ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিও কমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৯৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। আর গত বছর শেষে এ ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ এসেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ এসেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। আর রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দিয়েছে ভারত। এছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প ঘিরে জাপান থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকার সমপরিমাণ ঋণসহায়তা নেয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের স্থিতি এখন ১১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ রয়েছে ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছর থেকে অনেক মেগা প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হচ্ছে। এতে বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। এমনিতেই দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ায় আরো বেশি পরিমাণে ডলারের প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী রেমিট্যান্স, রফতানি আয়সহ দেশের ডলার সংস্থান বাড়ানো যাচ্ছে না। বিপরীতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় ক্রমাগত বাড়ছে।
ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করলে বাংলাদেশ আরো বড় অংকের ঋণের ফাঁদে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন অনেকে। রাজস্ব আয় কম থাকায় আবার এছাড়া কোনো পথ খোলাও নেই সরকারের সামনে। সরকারি ব্যয় কমিয়েও ঋণ পরিশোধ কঠিন। সরকারের আয় বাড়ানোর ওপর মনোযোগ বাড়াতে হবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় সংশোধন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। আপাতত অপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত সরকারের। এছাড়া প্রকল্প দীর্ঘায়িত করে ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। দ্বিপক্ষীয় ঋণের ক্ষেত্রে চুক্তির শর্ত কিংবা কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য আলোচনা শুরু করা উচিত। বছর দুয়েক ধরে যেভাবে রিজার্ভ ক্ষয় হচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ছে তাতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অপ্রয়োজনীয় কিংবা কম প্রয়োজনীয় ঋণ গ্রহণ থেকে সরকার বিরত থাকবে—এমনটাই কাম্য।
Leave a Reply