রীতা ভৌমিক : সিমিন হোসেন রিমি : রাজনীতিক এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। তিনি গাজীপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য এবং বর্তমানে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। এর আগে তিনি একাধিকবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও পদক্ষেপের মাধ্যমে উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে তাদের যুক্তকরণ ও গৃহকর্মে তাদের আর্থিক স্বীকৃতি প্রদানসহ নানা উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতিবেদক রীতা ভৌমিক
আপনার মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি একজন সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যদিকে আপনার বাবা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। পারিবারিক রাজনৈতিক আবহ আপনার রাজনীতিতে অংশগ্রহণে কতটা ভূমিকা রেখেছে বলে আপনি মনে করেন?
সিমিন হোসেন রিমি: আমার জীবনের বেড়ে ওঠাটা রাজনৈতিক পরিবেশে। সাড়ে চার বছর বয়সে ময়মনসিংহ জেলখানায় বাবার সঙ্গে দেখা করি। তখনো আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়নি, সে সময়েই আমি রাজবন্দি কাকে বলে, জেলখানা কী জানতে পেরেছি। আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বাবা জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসেন। এভাবে ছোটবেলা থেকেই মানুষের জন্য চিন্তা করার বিষয়টি প্রবলভাবে আমাকে নাড়া দিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই খবরের কাগজ পড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল। ১৯৭০ সালের ১০ ও ১২ নভেম্বরের কথা মনে পড়ছে। সেবার দেশের উপকূলীয় অঞ্চল সন্দ্বীপ, নোয়াখালী, হাতিয়া, ভোলা, মনপুরায় ঘূর্ণিঝড় হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমার বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় চলে যান অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। খবরের কাগজে বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করি। তখনি দেখি মরা মানুষের লাশ তারা তুলে আনছিলেন। এই সংবাদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জন্য কল্যাণ ভাবনাটা আমার ভেতর কাজ করে। বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোই হলো মানুষের জন্য কাজ করা। এই জিনিসগুলো আমাকে আলোড়িত করেছে।
১৯৭১ সালে আমরা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে অনেকদিন দেশের ভেতর শরণার্থী হয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। সেসময় হয়তো পানি পিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছি। লঞ্চে নদী থেকে টিনের মগ বা হাতের আঁচলা দিয়ে পানি তুলে পান করেছি। এর কিছুক্ষণ পরই দেখতে পেয়েছি, রক্তে ভেসে যাচ্ছে একটা লাশ। পানিও রক্তে লাল হয়ে গেছে। এ ধরনের দৃশ্য দেখতে দেখতেই আমাদের বড় হওয়া।
১৯৭১ সাল আমাদের সবার জীবনে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিশেষ করে যারা বুঝতে পেরেছি, রাজনৈতিক আবহে বড় হয়েছি, তাদের জীবন পাল্টে দেয় একাত্তর। সব কিছুর মধ্যে একটা কল্যাণ ভাবনা আমার ভেতরে কাজ করে, আলোড়িত করে। তবে সরাসরিভাবে রাজনীতিতে আসব—এমন চিন্তাভাবনা ছিল না। কারণ আমি মানুষের জন্য বরাবরই কাজ করেছি।
আমাদের এলাকায় উপনির্বাচনে যখন সংসদ আসন শূন্য হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অনেক ভালোবাসা ও আস্থা দিয়ে আমাকে এ জায়গায় কাজ করার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। তিনি আমাকে বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ করে দেন। সেখান থেকে আমি আজ এ জায়গায় এসেছি। আমার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আমি মনে করি, পদ, পদবি দায়িত্ব বাড়ায়। কর্তব্যের পথে আরও মানুষকে অগ্রসর করে। আমি আমার সব কাজ সেই কল্যাণ ভাবনা ও দায়িত্ব বোধ থেকে করতে চাই।
আমরা জানি, আপনি ছোটবেলা থেকে দুস্থ, অসহায় কন্যাশিশু ও নারীদের উন্নয়নে আপনার সাধ্যমতো কাজ করার চেষ্টা করেছেন। এখন আপনি একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন? এখন দুস্থ, অসহায় কন্যাশিশু ও নারীদের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে কী ভাবছেন?
সিমিন হোসেন রিমি: দুস্থ, অসহায় নারী, শিশুর জীবন মানোন্নয়নের জন্য সরকারি পর্যায়ে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ে অনেক কর্মসূচি রয়েছে। আত্মকর্মসংস্থানের চেষ্টা করা, বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং শিশুদের শিশুবান্ধব পরিবেশ দেওয়ার জন্য ডে কেয়ার সেন্টার নির্মাণ শুরু হয়েছে। এসব জায়গায় আমরা নতুন চিন্তাভাবনা, সময়োপযোগী কিছু চিন্তা করছি। আগে আমাদের ট্র্যাডিশনাল সেলাই মেশিন ছিল। এখন আমরা চিন্তা করেছি ট্র্যাডিশনাল সেলাই মেশিন যেটা দিয়ে শুধু সেলাই করা হয়, এটাতে যদি এমব্রডয়ারি সংযোগ করা হয়, তাহলে তারা পাঞ্জাবি, বাচ্চাদের কাপড়, সালোয়ার কামিজ তৈরি করে সেটাতে এমব্রডয়ারি করতে পারবেন। বিক্রির ক্ষেত্রে তাদের অর্জনটা ভালো হবে। এ ধরনের আরও কিছু সংযোগের চিন্তা-ভাবনা করছি। সময়োপযোগী কোনো কাজে কে কতটা উপযোগী—তাকে সেই কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়া। প্রশিক্ষণের পর প্রশিক্ষণার্থী সেটা ধরে রাখতে পারছেন কি না, সে জায়গাটায় আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।
বাংলাদেশে নারীর আর্থসামাজিক অবস্থান কোন পর্যায়ে বলে মনে করেন?
সিমিন হোসেন রিমি: শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অনেক অগ্রগতি হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষায়, উচ্চ পর্যায়ে নারীদের অনেক অবস্থান রয়েছে। আর্থসামাজিক অবস্থানের কথা ভাবলে, সেখানে নারীদের অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন?
সিমিন হোসেন রিমি: যা জনগণের জন্য ভালো, সেই কাজগুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি।
নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন ?
সিমিন হোসেন রিমি: নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তারা সমাজের একজন শিক্ষক। শিক্ষার্থী, ছাত্র বা ছাত্রীর প্রতি একজন গুরুজন হিসেবে তাদের যে দায়িত্ব, বাবা-মায়ের পরে শিক্ষকের যে ভূমিকা, সেই জায়গাটায় আমাদের সমাজকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যতরকম পদক্ষেপ নেওয়া যায়, নিতে হবে। এটা যে শুধু মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় করবে তা নয়, এটা সব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। যার যেখানে সম্পৃক্ততা রয়েছে সেখানে কাজ করতে হবে। নাগরিক সমাজকেও কাজ করতে হবে। আমাদের সমস্যা আছে সমাধান করতে হবে। যদি দোষ দিই, এই যে সরকার করছে না। দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সমস্যাকে চিহ্নিত না করলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারব না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যন্ত্রের যন্ত্রণা, প্রতিটি জিনিসের উচ্ছৃষ্ট অর্থাৎ মন্দ জিনিসগুলো সামনে চলে আসে। এখান থেকে মানুষকে ঠিক করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নতুন কোনো পদক্ষেপের চিন্তা আছে কি না ?
সিমিন হোসেন রিমি: নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক রকম সেল রয়েছে। যে কোনো রকমের সমস্যায় পড়লে বা নারী নির্যাতনের শিকার হলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯-এ কল করতে পারেন। সামাজিকভাবে প্রতিটি জায়গায়, উপজেলা পর্যন্ত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি রয়েছে। এগুলো কাজ করছে বলেই কিন্তু অনেক দেশের চাইতে আমাদের দেশের অবস্থা অনেক ভালো।
নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে মন্ত্রণালয় কী করবে?
সিমিন হোসেন রিমি: নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ, তাদের জয়িতার মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি করা। বড় ধরনের কোনো আর্থিক সহায়তা চাইলে সমবায়ের মাধ্যমে কাজ করার যে প্রবণতা, সেটাকে গড়ে তোলার জন্য চিন্তা করছি।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারী গৃহকর্মে নিয়োজিত। কিন্তু তাদের সেই অবদানের আর্থিক স্বীকৃতি নেই, জিডিপিতেও তা অন্তর্ভুক্ত নয়, এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না?
সিমিন হোসেন রিমি: এটা নিয়েও ভাবছি। নারী যে গৃহকর্মে নিয়োজিত, নিজের বিছানা করা, রান্না করা এগুলোও নারীর কাজ। এ ছাড়া যারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন, এখানে একটা কথা বলা দরকার। আমরা মানুষ হিসেবে জন্ম নিই। প্রথম আমার পরিচয় আমি একজন মানুষ। এরপর ভাগ হয়ে যাই লিঙ্গে। পুরুষের পাশাপাশি নারী। উন্নত বিশ্বে সবাই ভাগ করে কাজ করে পুরুষ কিংবা নারী। সেই ব্যবস্থায় নিয়ে আসতে পারি আমাদের চিন্তাটাকে। মনের যে সংস্কৃতি, মনের যে চিন্তা-চেতনার জায়গাটা তাহলে আমার মনে, আমরা যে চিন্তা করছি, আর্থিক স্বীকৃতি, জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টা নিয়ে আলোচনা চলছে। নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে আমরা এটা করব। কালবেলা
Leave a Reply