শবনম মুসতারিন.নিউইয়র্ক থেকে : ২১ ফেব্রুয়ারী। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে (১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন) ‘বাংলা’কে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র-যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি ও প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। এ সময় সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। দিবসটি একদিকে শোক ও বেদনার, অন্যদিকে মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে নিউইয়র্কে এদিন ভোরে প্রভাতফেরী উদযাপনের মধ্যে দিয়ে দিনব্যাপী নানা আযোজনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে ব্রঙ্কসের বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস-বাফা ইউএসএ। করোনাকালীন সামাজিক সুরক্ষা বজায় রেখে প্রভাতফেরীতে নানা পেশা ও বয়সের নারী পুরুষ অংশ নেন। বাবা-মায়ের হাত ধরে প্রভাতফেরীতে আসা শিশুদের কণ্ঠেও প্রতিধ্বণিত হতে থাকে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি।
সিরাজ উদ্দিন আহমেদের পরিচলনায় প্রভাত ফেরীতে সহযোগিতা করেন বাফার সদস্য ফারজানা ইয়াসমিন, জান্নাতুল আরা, আয়েশা চৌধুরী, মনিরা নূর ও শান্তনুর রহমান। প্রভাতফেরী শেষে বাফা সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সাধারন মানুষ বাফা কার্য্যালয়ে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে বাফাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা ২১ ফেব্রুয়ারী সকালে প্রভাতফেরির মাধ্যমে একুশ উদযাপন করে।
দিন ব্যাপী আয়োজনের মধ্যভাগে বাফা কার্য্যালয়ে সীমিত পরিসরে উম্মুক্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আনোয়ারুল লাভলু’র পরিচালনায় বাফার সদস্যগণ কবিতা আবৃত্তি, ভাষার আন্দোলনের ইতিহাস পাঠ ও দেশের গান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় বাঙালী কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ ও অভিভাবকগণ বক্তব্য রাখেন। এসময় বাফার নির্বাহী পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভাষা শহীদদের সম্মানে প্রফাতফেরী সহ দিনব্যাপী এই আয়োজন করতে পেরে আমরা আনন্দিত। এবছর বাফা ১০ বছরে পা রাখলো। দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় যারা বাফার সাথে ছিলেন এবং আছেন তাদের সবাইকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী, বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী এবং বাফার এক দশক উদযাপনে সারা বছর ধরেই বাফা নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা করেছে।সন্ধ্যায় বাফার নিয়মিত মাসিক আয়োজন ‘মাসান্তের বৈঠক ৭’ এর অংশ হিসাবে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘বর্ণমালার সাথে’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন শামীম আরা বেগম, বেনজির শিকদার ও জান্নাতুল আরা। সমবেত কণ্ঠে ’আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। অংশগ্রহন করেন, সুরাইয়া বেগম, জান্নাতুল আরা, কানিজ ফাতেমা, আয়েশা চৌধুরী, অর্চনা পল, ফারজানা ইয়াসমিন, সামান্তা রহমান, শামীম আরা বেগম, মো নাসির উল্লাহ ও রাজদ্বীপ। অনুষ্ঠানে বাফার বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহন করেন। শিশুদের বিভাগে কবিতা পাঠ করে শ্রেয়শী, কাম্য, ইফরা, তানহা, মৃত্তিকা ও জামি। কিশোর বিভাগে জায়েনা, আদিব, জুয়াইরা, ইশরাত, আবৃত্তি এবং বড়দের বিভাগে কথা, সারাফ, নাসিমা ও মায়া এন্জেলিনা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পাঠ করেন বাফার শিক্ষার্থী আরিশা ও সামান্তা।
রেহানা মতলুবের গীটারে ’ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়’ গানটি দর্শকদের মধ্যে এক অন্যরকম ভাললাগা তৈরী করে। অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন বাফার শিক্ষক সুরাইয়া বেগম, শিক্ষার্থী রাজদ্বীপ ও সামান্তা। এছাড়াও অতিতি শিল্পী হিসেবে দেশের গান পরিবেশন করেন উদয় ও অর্পিতা। অনুষ্ঠানে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন প্রবীন শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী, কবি আসাদ চৌধুরী এবং শিক্ষক, গবেষক ও নাট্যকার রতন সিদ্দিকী। এছাড়াও বাফার নৃত্য বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে মনোমুগ্ধকর নৃত্য পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানের শেষে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মতলুব আলীর কথা ও সুরে গান পরিবেশন করেন আলী পুষ্পিতা মউরি এবং অন্যান্য শিল্পীবৃন্দ। শিল্পী ও শিক্ষক মতলুব আলীর সহযোগীতায় অনুষ্ঠানটির সার্বিক পরিকল্পনায় ছিলেন ফরিদা ইয়াসমিন।
ভাষা আন্দোলনের এই অনন্য ইতিহাসকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেসকো ১৯৯৯ সালে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বাঙালির আত্ম-অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দিনটি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বেই পালিত হয়ে আসছে।
Leave a Reply